ইসলাম ধর্মে সন্তান পালক বা দত্তক নেয়া নিষিদ্ধ কেন?

জেনে আশ্চর্য হয়েছি এটা অনেকেই জানেন না! যাই হোক, সুরা আহযাব নাযিল হবার পর ইসলাম অনুসারী কোন মুমিন তার উত্তরাধীকারী হিসেবে নিজ ঔরসহীন কাউকে সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারবে না। সুরা আহযাবের স্পষ্ট করে ঘোষণা করা হয়েছে- مَّا جَعَلَ اللَّهُ لِرَجُلٍ مِّن قَلْبَيْنِ فِي جَوْفِهِ وَمَا جَعَلَ أَزْوَاجَكُمُ اللَّائِي تُظَاهِرُونَ مِنْهُنَّ أُمَّهَاتِكُمْ وَمَا جَعَلَ أَدْعِيَاءكُمْ أَبْنَاءكُمْ ذَلِكُمْ قَوْلُكُم بِأَفْوَاهِكُمْ وَاللَّهُ يَقُولُ الْحَقَّ وَهُوَ يَهْدِي السَّبِيلَ (আল্লাহ কোন মানুষের মধ্যে দুটি হৃদয় স্থাপন করেননি। তোমাদের স্ত্রীগণ যাদের সাথে তোমরা যিহার কর, তাদেরকে তোমাদের জননী করেননি এবং তোমাদের পোষ্যপুত্রদেরকে তোমাদের পুত্র করেননি। এগুলো তোমাদের মুখের কথা মাত্র। আল্লাহ ন্যায় কথা বলেন এবং পথ প্রদর্শন করেন।) [সুরা আহযাব: ৪]

অথচ ইসলাম ও নিজেকে নবী হিসেবে ঘোষণার ১৩ বছর পর্যন্ত জায়েদ নামের একজনকে হযরত মুহাম্মদ নিজের পালক সন্তান হিসেবে ও তার উত্তরাধীকারী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। জায়েদকে শিশু অবস্থায় মুহাম্মদ দত্তক নিয়েছিলেন। তখনো তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেননি। এর মানে ইসলামের আগের যুগে দত্তক নেয়ার বিধান ছিল। এক পর্যায়ে জায়েদকে তার জন্মদাতা পিতা-মাতা ফিরিয়ে নিতে আসলে মুহাম্মদ জায়েদকে যেতে দেননি। তিনি মক্কাবাসীর সামনে জায়েদকে নিজের সন্তান ও উত্তরাধীকারী হিসেবে পরিচয় করে দেন। পরবর্তীকারে জায়েদের সঙ্গে নিজের কাজিন জয়নবকে বিয়ে দিয়ে পুত্রবধু হিসেবে ঘরে আনেন। ইসলাম ঘোষণার ১৩ বছর পর্যন্ত জায়েদ যে মুহাম্মদের পালক সন্তান তাতে তো কোন সমস্যা হয়নি আল্লাহপাকের। তাহলে কি এমন ঘটল যে মানব সভ্যতার অন্যতম সুন্দর মানবিক নিদর্শন সন্তান দত্তক নেয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেলো?

এই প্রশ্নের উত্তরে ইসলামিস্টরা দাবী করেন, পালক সন্তানদের সম্পত্তিতে ভাগ দেয়া বন্ধ করতেই এটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ যুক্তি একদমই দুর্বল। কেননা সন্তান দত্তক নিষিদ্ধ করার জন্য পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার কোন দরকার পড়ে না। কুরআনের একটা সুরা নাযিল করেই পালক সন্তান ও তার স্ত্রীকে পর করে দেযা যায়। বাদ দেয়া যায় পিতা ও শশুড়ের সম্পর্ক। বঞ্চিত করা যায় উত্তরাধীকার ও সম্পত্তি থেকে। তার জন্য কিছুতে পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার প্রয়োজন নেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার জন্য দত্তক নেয়াটাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছিল! এটা না করলে জয়নবকে কিছুতে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। একমাত্র আল্লাহ যদি সুরা নাযিল করে দত্তক নেয়া প্রথাকে মানুষের বানোনো, অগ্রহণযোগ্য বলে সম্পর্ক ডিসমিস করে দেন তাহলেই জয়নবকে বিয়ে করলে লোকে পুত্রবধূকে বিয়ে করা হয়েছে বলে কটুক্তি করতে পারবে না। কিন্তু সে যুগেও তুমুল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল জয়নবকে বিয়ে করা নিয়ে। অথচ মক্কার মানুষ জায়েদকে ‘জায়েদ বিন মুহাম্মদ’ বা মুহাম্মদের ছেলে জায়েদ বলে সম্বধন করত। আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন- ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِندَ اللَّهِ فَإِن لَّمْ تَعْلَمُوا آبَاءهُمْ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَمَوَالِيكُمْ وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيمَا أَخْطَأْتُم بِهِ وَلَكِن مَّا تَعَمَّدَتْ قُلُوبُكُمْ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا (তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাক। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত। যদি তোমরা তাদের পিতৃ-পরিচয় না জান, তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই ও বন্ধুরূপে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে তোমাদের কোন বিচ্যুতি হলে তাতে তোমাদের কোন গোনাহ নেই, তবে ইচ্ছাকৃত হলে ভিন্ন কথা। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।) [সুরা আহযাব: ৫]

আসলে সুরা আহযাবের ৩৭ নম্বর আয়াতেই সব পরিষ্কার হয়ে যায় যেখানে জয়নবকে বিয়ে করার বিষয়ে নবীর আকুলতা সেখানে প্রকাশ পায়। وَإِذْ تَقُولُ لِلَّذِي أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَاتَّقِ اللَّهَ وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَاهُ فَلَمَّا قَضَى زَيْدٌ مِّنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِي أَزْوَاجِ أَدْعِيَائِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ مَفْعُولًا (আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন; তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করছিলেন, যা আল্লাহ পাক প্রকাশ করে দেবেন আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে।) [সুরা আহযাব: ৩৭]

এবার বলুন তো ৩৭ নাম্বার আয়াত পড়ে কি বুঝলেন? ‘অতঃপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে’- বাহ্, দত্তক নেয়ার সুমহান একটি প্রথাকে নিষিদ্ধ করার এই দরকারী কথা? হাজার হাজার যুদ্ধশিশু, পথশিশু, এতিম শিশুকে যারা বুকে টেনে নেন নিজ সন্তানতুল্য করে, সম্পত্তিতে ভাগ দেন, সামাজিক মর্যাদা দেন, সেই মহানুভতাকে এক কথায় খারিজ করে দেয়া হয়েছে যাতে পালক সন্তানদের তালাক দেয়া স্ত্রীদের পালক পিতারা বিয়ে করতে পারে! একদিন যে নারীকে বউমা বলে সম্বধন করেছে, যে নারী শ্বশুড় বলে জ্ঞান করেছে- তার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কি রুচিতে মানুষ মেনে নিতে পারে? এখানে নৈতিকতার শিক্ষাটা কি?



Leave a comment

About Me

সুষুপ্ত পাঠক aka Susupto Pathok is a blogger. He wrote anti-fundamentalist, anti-nationalist, anti-religious writings. Writes in favor of humanism, gender equality, non-communal society.

Newsletter

https://www.facebook.com/profile.php?id=100089104248214