ওহুদের যুদ্ধের বাস্তবতায় প্রফেট মুহাম্মদ

ইসলামকে বুঝতে হলে তার যুদ্ধের ইতিহাসকে পড়তে হবে। ইসলাম শান্তির ধর্ম না তরোয়ালের জোরে জয় করা ধর্ম- যুদ্ধ ছাড়া এত পরিস্কারভাবে বুঝা যাবে না। মুহাম্মদ প্রোফেট না একজন সেনানায়েক তা যুদ্ধের ময়দানেই ফয়সালা হয়ে যায়। ইসলাম কোন ধর্ম না একটি রাজনীতি- যুদ্ধ ছাড়া সেই সত্যে পৌঁছানো যাবে না…।

উহুদের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় ১৫ শাওয়াল, শনিবার। বদর যুদ্ধে কুরাইশদের পরাজয় হয়। উহুদ সেই প্রতিশোধের যুদ্ধ। তবে যুদ্ধ কিছু উম্মদ ছাড়া বিনা কারণে কেউই পছন্দ করে না। কেবলমাত্র ন্যায্য প্রতিশোধ, পরাধীনতার জ্বালা মানুষকে যুদ্ধে প্ররোচিত করে। কিন্তু কিছু রক্তলোলুপ আছে যাদের নেশাই হলো যুদ্ধ। বেশিরভাগ মানুষ যুদ্ধকে এড়াতে চায়। হোক তা “ধর্মযুদ্ধ”।

এরকম মনে করার কোন কারণ নেই যে, হযরত মুহাম্মদের একটি আহ্ববানই যথেষ্ঠ ছিল তার অুনসারীদের জন্য যুদ্ধে যাবার জন্য। যুদ্ধের যোগদানের জন্য আল্লাকে তাই নানা সুরায় বিনীত অনুরোধ করতে দেখা যায়। পরকালে দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি। মিষ্টি কথায় কাজ না হলে দোযগের আগুনের ভয়! (2:216:তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। পক্ষান্তরে তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না)… যুদ্ধ করতে হলে অর্থের প্রয়োজন। তা তিনি প্রোফেটই হোন আর যাই হোন, টাকা ছাড়া যে তারও চলে না। আল্লাহ তো আর আকাশ থেকে টাকার বস্তা এনে ফে্লেন না। তাই আল্লাকে টাকা-পয়সার জন্য মানুষের কাছেই ভিক মানতে হয়। তিনি বলেন, আল্লার রাস্তায় জান ও মাল দান করো (যে লোক আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে যোগদান করবে শহিদ হলে আল্লাহ তাকে বেহেস্তে প্রবেশ করাবেন বিজয়ী হলে গণিমতের মালসহ তাকে পুরস্কৃত করবেন। বুখারি, ভলিউম, বই৯৩, হাদিস৫৫৫) …।

যদিও মুহাম্মদ তার অনুসারীদের আশ্বাস দিয়েছেন তার যুদ্ধে যারা মারা যাবে তাদের বেহেস্ত নিশ্চিত। তবু বেঘোরে কেউ নিজের জানটা সহজে দিতে চায় না। নিশ্চিত অহেতুক মৃত্যূ জেনে এক উম্মাদ ছাড়া শত বেহেস্তের লোভেও কে আর রাজি হবে? হযরত মুহাম্মদের দলে সবাই-ই উম্মাদ আর তার অন্ধভক্ত ছিল না। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুল।

মদিনা ও উহুদের মধ্যবত্তি শাওত নামক স্থানে পৌঁছার পর প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক নিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুল আলাদা হয়ে গেলো। তিনি বললেন- রসুল্লাহ (সা:) ওদের কথা শুনলেন আমার কথা শুনলেন না। হে জনতা আমি বুঝি না আমরা এতগুলো লোক কেন এখানে প্রাণ দিতে যাবো! সে তার গোত্রের লোকদের নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। উল্লেখ্য, মুহাম্মদেরও ইচ্ছা ছিল মদিনায় অবস্থান করার, মুশরিকরা মদিনাতে আসলেই মোকাবেল করা যাবে- এই ছিল তার ইচ্ছা। কিন্তু অন্যান্যদের বিশেষত যারা বদরের যুদ্ধে অংশ নেয়নি তারা যুদ্ধে কিছু একটা করে দেখানো জন্য আগ্রহী ছিল। তাদের ইচ্ছাতেই মদিনা ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। ইবনে সলুল মুহাম্মদকে অনুরোধ করেছিল মদিনায় থেকে যাবার জন্য। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। তাছাড়া যুদ্ধকে এড়ানোও যাবে। কাফিররা যদি মদিনা আক্রমণ করে তাহলেই শুধু পাল্টা আক্রমন করা হবে। কিন্তু নিশ্চিত অহেতুক রক্তক্ষরণ দেখে ইবনে সলুল তার অনুসারিদের নিয়ে ফিরে গেলেন।

যুদ্ধের প্রস্তুতি শেষ এবার যুদ্ধ হবে। দুপক্ষই মুখোমুখি। মুহাম্মদ তার অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বললেন, নিজ তরবারী দেখিয়ে,- এই তরবারীর হক আদায় করতে কে প্রস্তুত আছো? অনেকেই এগিয়ে গেলো কিন্তু তিনি কাউকেই তরবারীটা দিলেন না। আবু দুজনা বললেন, ইয়া রসুল্লাহ, এই তরবারীর হক কি? উত্তরে মুহাম্মদ বললেন, এই তরবারী দিয়ে শত্রুকে এত বেশি আঘাত করতে হবে যেন তা বাঁকা হয়ে যায়। আবু দুজনা এই শর্ত মানলেন এবং তরবারীটা হাতে নিলেন…। এই হচ্ছে বিশ্ব রহমতের জন্য প্রেরিত একজন রসূলের তার অনুসারিদের প্রতি শান্তির বাণী! এই হচ্ছে শান্তির ধর্মের মর্মবাণী! আসলে এ হচ্ছে একজন সেনানায়েকের বক্তব্য। কোন প্রেফেটের, যিনি সমস্ত বিশ্বের জন্য হেদায়াতের ও রহমতের জন্য এসেছেন তার উক্তি এরকম হতে পারে না। এতো যুদ্ধকে বিভিষিকাময় করে দেয়ার ইন্দন! একজন যোদ্ধাকে সর্বাধিক নিষ্ঠুর হতে নিচতম প্ররোচনা! ইহুদী বুড়ির পথে কাটা দেয়া আর মুহামম্মদের কষ্ট পেয়েও তাকে ক্ষমা করা, কাফেরদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার যে গপ্পো কাহিনী আমাদের শোনানো হয় তার পাশাপাশি এই কাহিনীও পড়তে হবে। আমরা তাই কাহিনীতে আরো এগুতে থাকি। উহুদের যুদ্ধ এখন শুরু হবে…।

মুহাম্মদ তার সাহাবীদের যুদ্ধের ময়দানে পরস্পরকে চেনার জন্য একটা সঙ্কেত শিখিয়ে দিলেন “আমিত, আমিত”! এর অর্থ “মরণ আঘাত হানো”, “মরণ আঘাত হানো”! …তাই হয়েছিল উহুদের ময়দানে। দুনিয়াতে শান্তির পয়গাম নিয়ে আসা তথাকথিত “শান্তির ধর্ম ইসলাম” আর আরব প্যাগন ধার্মীকরা একে-অপরের প্রতি মরণ আঘাতই হানছিল। এটা ইসলামকে মহৎ করেনি। প্রতিটি যুদ্ধ ইসলামকে নিচে থেকে নিচে নামিয়েছে তার দাবীকৃত “শান্তি” থেকে।

আসলে ইসলাম প্রসারের সবচেয়ে সহজ পথ ছিল পরাজিতদের কাছে প্রস্তাব পাঠানো- হয় ইসলাম গ্রহণ করো নয় তো তরোয়ালের নিচে মাথা দাও! মুহাম্মদের ঘোষণাই ছিল ইসলাম কবুল করলে অতিতে সমস্ত দোষ-অন্যায় তিনি ক্ষমা করে দিবেন। যেমন ওয়াহশীর কথা বলা যায়। যুবাইর ইবনে মুতয়িমের গোলাম ছিল ওয়াহশী। উহুদের যুদ্ধে এই ওয়াহশী যদি মুহাম্মদের চাচা হামযাকে হত্যা করতে পারে তাহলে তার মালিকের শর্ত ছিল সে মুক্ত হয়ে যাবে। অসম্ভব ভাল যোদ্ধা ছিলেন হামযা। তবু ওয়াহশীর হাতে প্রাণ যায় হামযার। ওয়াহশীর ছোড়া বর্শা হামযার তেল পেট এফাড়ো- ওফোড় করে দেয়। লুটিয়ে পড়ে হামযা। মক্কা ফিরে যাবার পর ওয়াহশীকে স্বাধীন করা হয় তার গোলামী জীবন থেকে। কিন্তু মুহাম্মদের মক্কা জয়ের পরে ওয়াহশী প্রমোদ গুণতে লাগলো। ভয়ে সে মক্কা ছেড়ে তায়েফে পালিয়ে যায়। পরে একজন তাকে বলে কেবল মাত্র ইসলাম গ্রহণ করলেই মুহাম্মদ তাকে ক্ষমা করবেন। ওয়াহশী ইসলাম গ্রহণ করে রক্ষা পান।

কুরাইশ পক্ষের আবু সা’দ হুংকার দিলো, আমি বিভীষিকা সৃষ্টিকারী! হযরত আলী পাল্টা জবাব দিলেন, আমি বিভীষিকার বাবা! উবায় ইবনে খালাফ মুহাম্মদকে তার প্রিয় ঘোড়ায় চড়ে হত্যা করার ঘোষণা দেয় উহুদের যুদ্ধের আগে। মুহাম্মদও তখন পাল্টা ঘোষণা দেন, আল্লাহ চাহে তো আমিই তোমাকে হত্যা করবো।

তীব্রভাবে যুদ্ধাপরাধ ছড়িয়ে পড়ে উহুদের ময়দানে। “শান্তির ধর্ম প্রচারকারী নবী” স্বযং হিংসাকে বশে আনতে পারেন না । শুরুটা কুরাইশদের পক্ষ থেকে। আবু সুফিয়ানের দল মুহাম্মদের অনুসারীদের লাশগুলো কেটে বিকৃত করে ফেলেছিল প্রতিশোধ প্ররায়ন হয়ে। এসব দেখে মুহাম্মদ তীব্র বিদ্বেষভরে বলেছিল, আল্লাহ যদি আমাকে আর কোন রণাঙ্গনে কুরাইশদের বিরুদ্ধে জয়যুক্ত করে তাহলে ওদের ত্রিশজনের লাশকে এভাবে বিকৃত ও ক্ষতবিক্ষত করে ফেলবো! … যদিও পরে এই অভিলাশ থেকে মুহাম্মদ নিজেকে বিরত করেন এবং তার অনুসারীদেরও বিরত করেন।

এই হচ্ছে ইসলাম ও তার যুদ্ধের ইতিহাস! মক্কা বিজয়ের পর অবিশ্বাসী যারা একদিনের জন্যও মুহাম্মদকে নবী বলে মানেনি তাদের অনেকেই ইসলামকে কবুল করেছিল। আরব বুকে তাই ইসলামকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কিন্তু ইসলামের হাতে যে রক্ত লেগেছিল তা ১৪০০ বছর ধরেও ‍দুনিয়ার সমস্ত সাগরের পানিতেও মুছে যাবার নয়। আজকের বেকো হারাম, তালেবান, আইএসের যে যুদ্ধ- এ উহুদের ময়দানে যে ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়িয়েছিল সেই বিভীষিকার মধ্যেই তাদের জন্ম…।

উহুদের যুদ্ধে কুরাইশদের কাছে মুহাম্মদ বাহিনীর পরাজায় ঘটে। এমন একটা যুদ্ধের নাম বলা যাবে না যেখানে আল্লাহ মুসলমানদের অগ্রিম সুসংবাদ দিয়েছিল যে, তোমরা অবশ্যই এই যুদ্ধে জয় লাভ করবে। বরং জিতে যাবার পর ক্রেডিট নিয়েছে তিনিই নাকি জিতিয়ে দিয়েছেন! আবার হারার পর বলছেন, তিনি একটা শিক্ষা দিয়েছেন এর মাধ্যমে। অথবা ঈমানের একটা পরীক্ষা নিয়েছে যাতে তারা ধর্য্য দেখাতে পারে! উহুদের যুদ্ধের পরাজয় মুহাম্মদকে একজন স্রেফ রক্ত মাংসের মানুষ প্রমাণ করে যিনি একজন সেনানায়ক আর যুদ্ধের ময়দানে জয় পরাজয় দুটোই থাকে!

সূত্র: (সিরাতে ইবনে হিশাম: মূল-ইবনে হিশাম, অনুরাদ-আকরাম ফারুক। বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার)



Leave a comment

About Me

সুষুপ্ত পাঠক aka Susupto Pathok is a blogger. He wrote anti-fundamentalist, anti-nationalist, anti-religious writings. Writes in favor of humanism, gender equality, non-communal society.

Newsletter

https://www.facebook.com/profile.php?id=100089104248214