ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান খোঁজার বিপদ

বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কারের কথা ধর্মগ্রন্থের মধ্যে আগেই বলে দেয়া আছে- এরকম প্রচারণা ধর্মকে সামনের দিনগুলিতে ভয়ংকর বিপদে ফেলে দিবে। পাকিস্তানী নোবেলপ্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী ডঃ আব্দুস সালাম বলেছেন, “হিন্দু বিজ্ঞান, ইহুদী বিজ্ঞান, কনফুসিয়াস বিজ্ঞান ও খ্রীষ্টান বিজ্ঞান বলে কিছু নেই সেহেতু ইসলামিক বিজ্ঞান বলেও কিছু নেই”। আবদুস সালাম সাবধান করে বলেছিলেন, আজ বিজ্ঞানের যে আবিস্কারের সঙ্গে কুরআনের মিল পাচ্ছেন কাল বিজ্ঞানের সেই খিউরী ভুল প্রমাণিত হলে কি করবেন? পাশ্চত্যের অনেক বিজ্ঞানীও পোপকে সাবধান করেছেন বাইবেলে অহেতুক বিজ্ঞান খুঁজতে গিয়ে শেষে বাইবেলকে বিতর্কিত করবেন না…। বাংলাদেশের জাকির নায়েকের মুরিদদের অবশ্য এসবে কান নেই- তারা রোজ কুরআনে বিজ্ঞানের লেটেস্ট আবিস্কার খুজেঁ পায়। জাকির নায়েক বা হারুন ইয়াহিয়াদের প্রতারণা আসলে সাধারণ মুসলমানদের পক্ষে ধরা খুব কঠিন। শব্দের নতুন নতুন অর্থ বের করে তারা মানুষকে প্রতারিত করে। ইবনে কাথির, আল তালাবি বা বুখারীদের মত পন্ডিতদের করা কুরআনের ব্যাখ্যাকে আজকের যুগে জাকির নায়েকরা পাল্টিয়ে যুগপযোগি বানাচ্ছেন। ইবনে কাথিররা মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে “রক্তপিন্ড” থেকে এরকম ব্যাখ্যা করার পর ১৪০০ বছর কেটে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা ইবনে সিনা ও ইবনে কাইয়িমের মত বিজ্ঞানীরা আলাক্বা শব্দকে রক্তপিন্ডই জানতেন! এই মস্ত বড় ভুলটা হাজার বছর ধরে চলারও পরও মুসলিমদের কিছু যায় আসেনি। সাত আসমানে বসে আল্লাহও তো দিব্যি নিশ্চিন্তে বসে ছিলেন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের আবিস্কার যখন কুরআনের এই অপব্যাখ্যাকে মিথ্যা প্রমাণ করছে তখনই জাকির নায়েকরা উঠেপড়ে লেগেছে যে, কুরআন আসলে রক্তপিন্ড বলেনি, অথচ হাজার হাজার বছর ধরে কুরআনের সুরা আল মুমিনুন, সুরা আল হজ, সুরা আল কিয়াম ইত্যাদি সুরাগু্লোতে “রক্তপিন্ড” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথিবীর তাবদ ভাষায় কুরআনের “আলাক্বা” শব্দটিকে “রক্তপিন্ড” হিসেবে অনুবাদ করেছেন বিশিষ্ট সব ইসলামী আলেমগণ। সমস্যা হচ্ছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে মানব ভ্রুণের সৃষ্টি ধারাবাহিকতায় “রক্তপিন্ড” বলতে কোন ধাপ নেই। জাকির নায়েক বা হারুন ইয়াহিয়াদের অস্বস্তিটা এখানেই। তারা ভয় পেয়েছে মুসলিম ছেলেমেয়েরা মেডিকেলে পড়াশোনা করে কুরআন পাঠ করলে কুরেআনের মধ্যে ভুলটা দেখে ফেলবে। এইজন্য তারা “আলাক্বা” শব্দের নতুন অর্থ করেছেন “দৃঢ়ভাবে আটকে” থাকা! তারা দাবী করছেন জরায়ুর মধ্যে ভ্রুণের ঝুলে থাকাই কুরআন বুঝিয়েছে। কুরআনের মানুষের জন্মের যে ধাপ দেখিয়েছেন সেটা বীর্য থেকে জমাট রক্তপিন্ড, (এখন এটাকে দৃঢ়ভাবে ঝুলে থাকা বস্তু অনুবাদ করা হচ্ছে!) সেটা থেকে ছোট মাংসের টুকরা, তারপর হাড়, অবশেষে মাংস দিয়ে হাড়কে ঢেকে দেয়া। কিন্তু শুক্রাণু আর ডিম্বানুর মিলনের কথা কই? ডিম্বানু ছাড়া কি করে ভ্রুণর জন্ম হবে? মক্কায় নাযিল হওয়া সুরা আল মুমিনুনে বলা হয়েছে, “আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, অতঃপর তাকে আমি শুক্রাণুতে স্থাপিত করি এক নিরাপদ আধারে, পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি আলোকে (রক্তপিন্ডে), তারপর রক্তপিন্ডকে পরিণত করে হাড়ে, তারপর হাড়কে মাংস দিয়ে ঢেকে দেই, অবশেষে তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে…(সুরা আল মুমিনুন, ২৩: ১২-১৪)। এখানে ডিম্বানু ও শুক্রের মিলনের কোন কথাই নেই! যেন নারীর এখানে কোন ভূমিকাই নেই। মাদ্রাসায় দুই হুজুর মিলে মাঝে মাঝে যে সব ছহবতের খবর পাই তাহলে তো সেখানেই মুমিন বাচ্চা পয়দা হয়ে যাবার কথা! ডিম্বানুর যেখানে কোন প্রয়োজনই নেই!

 

 

তবু কুরআনে এইসব আংশিক বৈজ্ঞানিক ভ্রুণ বিদ্যার কথা কিভাবে সংযুক্ত হলো সেটা আমি লেখা্র শেষে উল্লেখ করবো। তার আগে আরো একটি “বৈজ্ঞানিক” তথ্য আমরা কুরআন থেকে দেখে নেই। সুরা ফুরকান বলছে-

//“কত মহান তিনি যিনি নভোমণ্ডলে সৃষ্টি করিয়াছেন রাশিচক্র এবং উহাতে স্থাপন করিয়াছেন প্রদীপ ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র।”(সূরা ফুরকান ২৫:৬১)//।

এই আয়াতে আজকের যুগের মুসলিম পন্ডিতরা চিৎকার করে প্রচার করে দাবী করেন যে, কুরআন ১৪০০ বছর আগে বলছে চাঁদের নিজস্ব আলো নেই যেটা বিজ্ঞান আজকে আবিস্কার করছে। এই দাবীটি অসত্য ও বিবৃত। চন্দ্রের নিজস্ব আলো নেই এটি কুরআন নাযিল হওয়ার ১ হাজার বছর আগে পৃথিবীর মানুষ জেনে গেছে। এরিস্টটল চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবী ছায়া দেখে বুঝেছিলেন পৃথিবী গোল ও চন্দ্রের আলো আসলে প্রতিফলিত আলো। গ্রীকরা মুহাম্মদের জন্মের ১ হাজার বছর আগেই জানে এসব তথ্য। এরিস্টটল কোন নবী ছিলেন না। তবু তেনা প্যাচানো যাদের স্বভাব তারা এখন বলতেই পারেন মুহাম্মদের মত একজন অশিক্ষিত লোকের তো এরিস্টটলের আবিস্কার বা সেসময়ের অশিক্ষিত আরবদের তো এসব জানার কথা না। তারা এসব কিভাবে জানল যদি না কুরআন আসমানী কিতাব না হয়? তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই আরবদের মাঝে এরিস্টটলের পরিচয় ছিল। ততদিনে আরবরা স্বল্প সংখ্যাক হলেও গ্রীকদের স্থাপিত শিক্ষালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হওয়া শুরু করেছিল। যেমন মুহাম্মদের কাজিন হারিস বিন কালাদ গ্রীক মেডিসিন পড়েন এবং উনি হিপোক্রিতাস, এরিস্টটল এবং গ্যালেনের মেডিকেল শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ধারনা করা হয় কুরআনে যত বিজ্ঞান আমরা দেখতে পাই তার সবই কালাদার কাছ থেকে মুহাম্মদ ধার করেছিলেন। কারণ কুরআনে মানব ভ্রুণ সৃষ্টির যে ধারাবাহিকতা দেখতে পাই সেটা হিপোক্রিতাসের থিউরী ছিল সেসময়ে। এসব কালাদাদের মেডিকেলে পাঠ্য ছিল। আরবদেশে সবাই অশিক্ষিত ছিলো, অন্ধকার যুগ ছিল, সবাই ভেড়ার রাখাল ছিল- এরকম একটা প্রেক্ষাপট সব সময় প্রচার করে ইসলাম বুঝানো হয় পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞানের আবিস্কারের প্রথম দাবীদার! অবশ্য চন্দ্রের নিজস্ব আলো বিষয়ে সুরা ফুরকানের গত ১৪০০ বছরে কিন্তু কোন আল্লার বান্দা দাবী করেন নাই বা পড়ে বুঝতে পারেন নাই যে চন্দ্রের আলো কি তার নিজের নাকি অন্যের। এটি সাম্প্রতিককালের হারুণ ইয়াহিয়া বা জাকির নায়েকদের আবিস্কার। তবু তাদের ব্যাখ্যা ধরেই দেখানো হলো চন্দ্রের নিজস্ব আলো নেই- এটা কুরআন বললেও কিছু যায় আসে না। কারণ এরিস্টটল আল্লার বলার হাজার বছর আগেই বলে দিয়েছিলেন। যে কারণে ইহুদীদের তাওরাত, খ্রিস্টানদের বাইবেলেও অনুরূপ কথা বলা আছে।

 

অনেকেই অভিযোগ করেন, শুধু কেন কুরআন থেকে এসব দেখাই, কেন তাওরাত, বাইবেল, বেদ, গীতা থেকে এসব তুলে ধরি না। আসলে আমার কাজটা কুরআনই সহজ করে দিয়েছে। কুরআন বলেছে ঐসব গ্রন্থ সব বাতিল। কাজেই এখন কুরআনকে মোকাবেলা করলেই চলে, বাকীদের তো স্বয়ং কুরআনই বাতিল করে দিয়েছে। তবে বাইবেল সম্পর্কে বলি, এখানে স্থীর পৃথিবীর কথা বলা আছে, এরচেয়ে হাস্যকর “বৈজ্ঞানিক থিউরী” আর কি হতে পারে? বাইবেল সম্পর্কে আইনস্টাইন এক কথায় যা বলেছেন সেটাই গ্রহণযোগ্য-

//“ ঈশ্বর শব্দটি আমার কাছে মানুষের দুর্বলতার বহির্প্রকাশ ও দুর্বলতা থেকে উৎপাদিত বস্ত্তর চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না । বাইবেল গ্রন্থটি খুবই ন্যায়পরায়নতবে আদিম কিংবদন্তির বেশি কিছু নয় । তার চেয়ে বড় কথা খুবই শিশুসুলভ এগুলো//।

 

প্রসঙ্গত হিন্দু ধর্মের কথা উঠবে এখন। আজকাল হিন্দু মুমিনরাও তাদের ধর্মীয় কিতাবে বিজ্ঞানকে দেখতে শুরু করেছেন। প্রায় হাজার হাজার বছর আগে চার্বাক দর্শন বলছে, –

//প্রতারক ধুর্ত পণ্ডিতগণ আপনাদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে পরলোক ও স্বর্গ-নরকাদির কল্পনা করিয়া জনসমাজকে বৃথা ভীত ও অন্ধ করিয়া রাখিয়াছে  বেদ অধ্যয়নঅগ্নিহোত্রদণ্ডধারণ,ভস্মলেপন প্রভৃতি বুদ্ধি ও পৌরুষশূন্য ব্যক্তিবৃন্দের উপজীবকা মাত্র…//।

অবশ্য বেদকে কিভাবে মূল্যায়ন করবো সেটা একটা সমস্যা। বেদের নাস্তিক ঋষিদের দর্শনগুলি কিছুতেই ধর্মমত নয়। আশ্চর্যজনকভাব সেটা সনাতন ধর্মের ঢুকে বসে আছে। সেই সব বস্তুবাদী ঋষিদের পৃথিবী সম্পর্কে চিন্তা নিঃসন্দেহে ধর্মীয় ব্যাখ্যার চাইকে অনেক অগ্রগামি। আমার আপত্তির জায়গাটা হচ্ছে, হিন্দু মুমিনদের সেই সব নাস্তিক ঋষিদের মতবাদ বা পৃথিবী সম্পর্কে তাদের দর্শনকে কোট করে নিজেদের হাস্যকর ধর্মকে সত্য বলে প্রচারের চেষ্টাকে। এটা নিয়ে আলাদা একটা লেখা লেখার ইচ্ছা রইল। এই লেখাটা এমনিতেই বড় হয়ে গেছে…।



2 responses to “ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান খোঁজার বিপদ”

  1. অনেক কিছু জানতে পারি আপনার ব্লগ পড়ে।ধন্যবাদ

    Like

Leave a comment

About Me

সুষুপ্ত পাঠক aka Susupto Pathok is a blogger. He wrote anti-fundamentalist, anti-nationalist, anti-religious writings. Writes in favor of humanism, gender equality, non-communal society.

Newsletter

https://www.facebook.com/profile.php?id=100089104248214