প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে কেন সক্রেটিসের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না

আবদুর রাজ্জাককে ‘বাংলার সক্রেটিস’ বলাতে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। তিনি বিদ্যান ব্যক্তি, পন্ডিত, চলন্ত বিশ্বকোষ, মহান শিক্ষক সব কিছু ঠিক আছে, এজন্য তার প্রতি আমারও সন্মান আছে কিন্তু তার সঙ্গে সক্রেটিসের তুলনা করাটা অযোগ্যতা নয় বরং বেখাপ্পা। ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীসের আদালতে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তিনি তরুণ সমাজকে প্রচলিত ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাস, অবজ্ঞা ও প্রশ্ন উত্থাপনে প্রধান প্রেরণাদাতা। গোটা এথেন্সের পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ সেক্রেটিসের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন কারণ সক্রেটিস তার সময়কাল নিয়ে সন্তুষ্ঠ ছিলেন না। পক্ষান্তরে এথেন্সের তখনকার বুদ্ধিজীবীরা প্রচলিত সব কিছুর উপরই ছিলেন আস্থাবান। ৭০ বছর বয়স্ক সক্রেটিস ২৯ বছরের প্লেটোর মত শিষ্যদের প্রচলিত ধর্ম সমাজ দেবতা আচার বিষয়ে প্রচন্ড রকমের অবজ্ঞা করতে, মুক্তিচিন্তা, যুক্তি প্রশ্ন উত্থাপনের যে বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার সঙ্গে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের মিল কোথায়? আবদুর রাজ্জাক পাকিস্তান ও জিন্নার প্রতি ছিলেন মুগ্ধ এবং শ্রদ্ধাবনত। তিনি সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একনিষ্ঠ অনুগামী ছিলেন এই যুক্তিতে যে পাকিস্তান হলে মুসলমানদের সাতন্ত্র ভাষা সাহিত্য আচার প্রতিষ্ঠা পাবে বাকী বাঙালী ও বাংলা ভাষা সাহিত্য আচার থেকে। এই মুসলিমবাদ থেকেই পাকিস্তান সৃষ্টি এবং বাংলাদেশ হবার পরও সেই একই মুসলিমবাদের চর্চা আবদুর রাজ্জাক আহমদ ছফাদের জারি থাকায় আজকের বাংলাদেশের যে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় চেতনার শক্তিশালী অবস্থান তার গোড়াঘর বলা চলে।

প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের নিন্দা করার জন্য এই লেখা নয়। শুধুমাত্র সক্রেটিসের সঙ্গে তুলনার ভুল জাজমেন্ট সম্পর্কেই এই রচনা। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগই ছিলো তিনি তরুণদের বিপদগামী করে তুলেছেন। আবদুর রাজ্জাককে ঘিরেও তরুণদের একটা বলয় ছিলো। আহমদ ছফা, সরদার ফজলুল করিম, আনিসুজ্জামান, সলিমুল্লাহ খান প্রমুখরা ছিলেন রাজ্জাকের শিষ্যদের অন্যতম। আর যাই হোক, ঢাকাতে গত চারশো বছরের ইতহাসে এমন একটা জেনারেশনের কথা জানা যায় না যাদের সঙ্গে নিদানপক্ষে কোলকাতায় ডিরোজিওয় শিষ্য ‘ইয়াং বেঙ্গলদের’ সঙ্গে তুলনা চলতে পারে। রাজ্জাকের শিষ্যদের সবাই ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের মানুষ ছিলেন এবং তাদের সকল অর্জন তাদের নিজস্ব। ইনারা কেউই রাজ্জাকের সঙ্গে মিশে ‘গোল্লায় যাচ্ছে’ সেরকম কোন শোরগোল কখনই শোনা যায়নি। রাজ্জাকের দুই শিষ্য ছফা এবং হালের সলিমুল্লাহ খান প্রবলমাত্রায় মুসলিমবাদী বুদ্ধিজীবী। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে কেমন করে বাঙালী সাহিত্য ভাষাকে মুসলিমানিত্ব করে একটা আলাদা রূপ দেয়া যায় সেই ফর্মুলা বের করার জন্য জীবনপাত করে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ বলা চলে। এইসব কর্মকান্ড প্রচন্ডভাবে মুসলিম জাতীয়তাবাদ দিয়ে প্রভাবিত যা সাম্প্রদায়িক নি:সন্দেহে। সেক্রেটিস ও তার শিষ্যদের নিয়ে এরকম সাম্প্রদায়িক তকমা কি দেয়া সম্ভব? ঐ যে বললাম ঢাকার চারশো বছরের ইতিহাসে সক্রেটিস ও তার শিষ্যদের সঙ্গে তুলনা চলে এমন একটি আখড়ার কথা বলা যায় না। অনেকেই শিখা গোষ্ঠির কথা বলতে পারেন। কিন্তু শিখা গোষ্ঠির প্রায় সকলেই ছিলেন ধর্মভীরু উদার মুসলিম মাত্র। এই গোষ্ঠির দুই একজন তো প্রফেট মুহাম্মদের দরদমাখা জীবনী লিখেছিলেন আবেগ আর কল্পনা মিশিয়ে। আমার আসলে এগুলোর কোনটি দেখিয়েই কাউকে কিছু বলার ইচ্ছে নেই। আমার আপত্তির জায়গাটি সক্রেটিসের সঙ্গে তুলনা কারণ সক্রেটিস তার সময়কে প্রশ্ন করেছিলেন এবং একটা জেনারেশনকে প্রশ্ন করে প্রচলিত ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে প্রফেসর রাজ্জাকের মিল কোথায়?

অপ্রাসঙ্গিক হবে না মনে করে ছোট্ট একটা বিষয় বলে লেখাটা শেষ করি। সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন, তার গুরু রাজ্জাক বলেছেন, ইংরেজ আসার ৫০০ বছর আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষে যুদ্ধবিগ্রহ ছিলো কিন্তু একটিও সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ হাঙ্গামা ঘটেনি। এই কথার অর্থ হচ্ছে মুসলিম শাসনকে দোষ মুক্ত করে ইংরেজ শাসনকেই সব রকম সাম্প্রদায়িকতার জন্য দায়ী করা। এই  ইতিহাসের উৎস কি? আবদুর রাজ্জাক সাহেব তার শিষ্যদের এই ইতিহাস জানতে একটি মাত্র যে বইটি পড়তে দিতেন তার নাম ‘সিয়ার উল মোতাখখিরীন’। এই কথা আমাদের জানাচ্ছেন স্বয়ং সলিমুল্লাহ খান। আশ্চর্যের কথা এতবড় পন্ডিত মানুষ রাজ্জাক কি মুসলিম শাসনকালে ফকির দরবেশদের প্রচন্ড চাপের কথা জানতেন না? শাসকদের সবাই যে এইসব ধর্মবেত্তাদের চাপের কাছে নতজানু হয়ে পড়তেন, যারা উপেক্ষা করতেন তাদেরকে উৎখাত করা হত ফকির দরবেশদের উশকানিতে সেই ইতিহাস বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন? ইতিহাসের একটা উদাহরণ দেই। জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কিকে বাংলা আক্রমন করার আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখেন চিশতিয়া তরিকার প্রধান নূর ই কুতুব ই আলম। এই দরবেশ তার চিঠিতে লিখেন, ‘বিশ্বাসের ঘরের যখন পতন হয়েছে, ইসলাম যখন এমন দুর্ভোগে নিপতিত হয়েছে, কেন তুমি সিংহাসনে মহানন্দে বসে আছো? জাগো, অগ্রসর হও এবং ধর্মকে রক্ষা করো, কেননা এটা তোমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব’। এই চিঠি পেয়ে ইব্রাহিম শর্কি রাজা গণেশকে সিংহাসনচ্যুত করতে অগ্রসর হন। রাজা গণেশ শক্তি ও সামর্থে পেরে উঠতে না পেরে নিজ পুত্র যদুকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সিংহাসনে বসান প্রতিপক্ষ ও প্রজাদের সন্তুষ্ঠ রাখতে। মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহাসিক ফিরিশতা (১৫৬০-১৮২০) রাজা গণেশকে একজন সুশাসক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। চিশতিয়ার সুফি দরবেশের চিঠি এবং ইব্রাহিম শকিংর আক্রমন তাহলে বাকী আর কোন তথ্য আমাদের সামনে এনে দেয়? সাম্প্রদায়িক কারণেই তাকে উৎখাতের আক্রমন ঘটেনি? তাহলে কিসের ভিত্তিতে প্রফেসর রাজ্জাক বললেন ইংরেজ আসার ৫০০ বছরের মধ্যে একটিও সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ হয় নাই?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে আগের থেকেই সাম্প্রদায়িকতা ছিলো ইংরেজরা তার সুযোগ নিয়েছে মাত্র। ব্যাধি ও প্রতিকার প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেন, ‘আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে। কথাটা যদি সত্যই হয় তবে ইংরেজের বিরুদ্ধে রাগ করিব কেন। দেশের মধ্যে যতগুলি সুযোগ আছে ইংরেজ তাহা নিজের দিকে টানিবে না, ইংরেজকে আমরা এতবড়ো নির্বোধ বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব এমন কী কারণ ঘটিয়াছে। মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা তত গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে’।

তাহলে মুসলিম শাসনে ভারতবর্ষে সবাই অসাম্প্রদায়িক শাসনে ছিলো কিংবা সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই- জাতীয় আবহ ছিলো এমন ইতিহাস প্রতিষ্ঠার কারণ কি? কারণটি সম্ভবত আমরা বুঝতে পারব যখন আজকের পৃথিবীতে জঙ্গিবাদের জন্য আমেরিকা ও তার মিত্রদের দায়ী করা হয় তার উপর মনোযোগ ফেললে। এখানেও কিন্তু আমেরিকা ও তার মিত্ররা কেবল সুযোগ নিচ্ছে মাত্র। ইসলামে জিহাদ আছে বলেই তো জঙ্গি দল গঠন করতে ডলার ঢালা যাচ্ছে। তাহলে শনিকে দোষ দিবেন নাকি নিজেদের ছিদ্রকে চিহ্নিত করে তার মেরামত করবেন? মুসলিম ও ইসলামকে রক্ষা করতে ছিদ্রটি উন্মক্ত রেখে খালি আমেরিকাকে দোষারোপ করে আমরা যা করতে চেয়েছি তেমনটাই ইংরেজদের উপর সকল সাম্প্রদায়িকতার দোষ চাপিয়ে নিজেদের (হিন্দু মুসলমানের) সাম্প্রদায়িক চেহারা আড়াল করতে চেয়েছি। প্রফেসর রাজ্জাক ও তার শিষ্যরা প্রচলিত সেই ব্যবস্থারই সেবক ছিলেন ও আছেন। তাহলে কি করে তার সঙ্গে সক্রেটিসের তুলনা চলে? উনারাই বা কি করে নিজেদের ‘সক্রেটিসের চ্যালা’ বলে দাবী করতে পারেন?



One response to “প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে কেন সক্রেটিসের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না”

  1. excellent observation

    Like

Leave a comment

About Me

সুষুপ্ত পাঠক aka Susupto Pathok is a blogger. He wrote anti-fundamentalist, anti-nationalist, anti-religious writings. Writes in favor of humanism, gender equality, non-communal society.

Newsletter

https://www.facebook.com/profile.php?id=100089104248214