মুসলিম লীগের “বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলা ভাষা সংস্কৃতি শাখা” ভিন্ন এক রবীন্দ্র জন্মদিনের জন্ম দিয়েছে। পঞ্জিকা পরিবর্তন করে ২৫ বৈশাখকে পশ্চিমবঙ্গের ২৫ বৈশাখ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। মুসলিম লীগের এই শাখাটিই ঢাকার সংস্কৃতির ধারক-বাহক। বাংলা একাডেমি তাদেরই। এরাই মুসলিম লীগের “মুসলিম জাতীয়তাবাদী শাখার” হাতে হিন্দুয়ানী ভারতের দালাল ট্যাগ খেয়ে আসছে সারাজীবন। আমরা আমাদের জীবনের ঊষালগ্নে মুসলিম লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদী শাখাকেই সেক্যুলার প্রগতিশীল বাঙালি সংস্কৃতি লালনকারী বলেই জেনেছি। এখনো তাদের প্রতি একই রকম মনোভাব আমার বন্ধুদের।
এই মুসলিম লীগের প্রগতিশীল শাখা রবীন্দ্রনাথের একটা গানকে জাতীয় সংগীত করার পর যে আত্ম-অস্বস্তিতে ভুগেছে তারই ফল স্বরূপ নজরুল হয়েছেন জাতীয় কবি। নজরুল মূলত কোলকাতার মানুষ। পূর্ববঙ্গ তার কবিতায় সাহিত্যে কোনদিনই ফুটে উঠেনি। তারপরও নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি কারণ নজরুল ‘মুসলমান’। রবীন্দ্রনাথের গান জাতীয় সংগীত, জীবনানন্দ দাশ জাতীয় কবি- কোন “প্রগতিশীল মুসলমান” এতখানি মনের থেকে মেনে নিতে পারবে?
বাংলা পঞ্জিকা পহেলা বৈশাখ, ২৫ বৈশাখ, ২২ শ্রাবণ, নজরুল জয়ন্তী, চৈত্র সংক্রান্তি, পৌষ, বসন্ত ছাড়া আজকের পৃথিবীর বাস্তবতায় এর কোন বাস্তব প্রয়োগ নেই। বাঙালি হিন্দু তার ধর্মীয় তিথি নক্ষত্র পালা পার্বন এই পঞ্জিকা দেখে আজো পালন করে থাকে। তাহলে ঢাকার বাংলা একাডেমির এত গরজ হলো কেন পঞ্জিকাটি পরিবর্তন করতে?
পাকিস্তান আমলে এই পঞ্জিকা পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। বৈজ্ঞানিকভাবে বিশুদ্ধ বাংলা ক্যালেন্ডার করাই ছিল যুক্তি। রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করা ও পঞ্জিকা পরিবর্তনের কাজ হাতে নেয়া দুটো অভিন্ন একটা লক্ষ্য। সেই ক্যালেন্ডার এরশাদ সরকার হয়ে বর্তমান সরকারের সময় বাস্তবায়িত হয়েছে।
এবারের যুক্তিটি আরো হাস্যকর। ১৯৫২ ও ১৯৭১ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ও ১৬ ডিসেম্বর তখনকার বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী যে বাংলা তারিখ ছিল সে স্মৃতি ধরে রাখতেই নাকি এই পঞ্জিকা পরিবর্তন! সেই সময় বাংলা তারিখকে ধরে রাখা মানে তো লোকনাথ পঞ্জিকাকেই ধরে রাখা হলো! বৈজ্ঞানিক বিশুদ্ধ পঞ্জিকার যুক্তিটি কি তাহলে এখানে খাটল?
রবীন্দ্রনাথ কেন আলাদা করে বাংলাদেশে পালিত হবে? বৈশাখ কেন আলাদা করে পালিত হবে? লোকে তো এখন দুটো বৈশাখের তারিখকে একটা ‘হিন্দুদের বৈশাখ’ অপরটিকে ‘মুসলমানদের বৈশাখ’ বলে। এরপর কি ‘মুসলমানদের রবীন্দ্র জন্মদিন’ বলবে? এই অনৈক্য রবীন্দ্র স্মরণ কি ঢাকার প্রগতিশীলদের মুসলিম লীগের আরো ডজনখানেক ডানপন্থী শাখার সঙ্গে লড়তে শক্তি দিবে?
মুসলিম লীগের “বাঙালি জাতীয়তাবাদী শাখা” “বাঙালি মুসলমান শাখা” “মুসলমান বাঙালি শুখা” “মুসলমান শাখা” সবগুলোর নিউক্লিয়াস হলো দ্বিজাতিতত্ত্ব। ফলে শরতচন্দ্র যখন শ্রকান্ত উপন্যাসে লেখেন ‘বাঙালি ও মুসলমান ছেলেদের মধ্যে ফুটবল খেলা’ তখন মুসলিম লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুসলমান বাঙালি জাতীয়তাবাদ উভয়ে অভিমান করে ফেলে। আবার দ্বিজাতিতত্ত্ব তাদেরকে কিছুতে কেবলই বাঙালি হতে দেয় না। তাহলে কি শরতচন্দ্রের এভাবে লেখা দরকার ছিল, ‘বাঙালি ও মুসলমান বাঙালি ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলা’?
বাঙালি জাতীয়তাবাদী আমি নই। রবীন্দ্রনাখ বিশ্ব নাগরিক হবার কথা বলেছেন। দরকারকে তাঁকে জাতীয়তাবাদী হতে হয়েছে ১৯০৫ সালে। যুবক রবীন্দ্রনাথ তার আশি বছরের ভ্রমণ শেষে বিশ্ব মানবতাকেই একটি অভিন্ন জাতীয়তাবাদ দেখেছেন। আমি কোন রকম জাতীয়তাবাদ (ধর্মীয় ও জাতিগত) ঘৃণা করি। একটা মিশ্র মাল্টি কালচার কসমোপলিট্রন সমাজকে সমাধান হিসেবে জানি। তবু বাঙালিত্বের কথা, তার শেকড়ের সন্ধানের কথা বারবার বলি কেন প্রশ্ন উঠতে পারে। আরে ভাই, যে জাতি এখন পর্যন্ত ধর্মীয় সংক্রীর্ণতা খেকে বেরিয়ে বাঙালি হতে পারলো না তারা কি করে বুঝবেন কসমোপলিট্রন? আগে অধুনিক হোক, তারপর তো অতি-আধুনিক হবে!
Leave a comment