গ্রামবাংলার ইসলাম কেমন?

দুটি ঘটনার উদাহরণ দিবো। একটা দেড়শো বছর আগের, আরেকটা সত্তর-আশি বছর আগের। গ্রাম বাংলার সহজীয়া ইসলাম, সাধারণ কৃষকের নাকি কী রকম নরম শরম ইসলাম ছিল, সেই ইসলামকে ফিরিয়ে আনতে হবে এইসব বলা হয়। এখন যে ওহাবি সালাফি ইসলাম দেখি ওয়াজি হুজুরদের, পাড়া মহল্লায় সেসব নাকি আমেরিকা ইরাক আক্রমন করার পর জন্ম নিয়েছে। মুসলমানদের উপর মার্কিনদের হামলার পর নাকি অভিমানী মুসলমানরা একটা বিদ্রোহ করেছিল, যেহেতু আরবরা এখনো ধর্ম থেকে বের হতে পারেনি তাই তাদের বিদ্রোহটা নাকি ইসলামের লেবাস লাগানো থাকে…।

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত শিক্ষক বুদ্ধিজীবী মার্কসবাদী লেখক কলামিস্ট ঘরোয়া আলোচনায় বলছিলেন এমন ব্যাখ্যা। যেহেতু ঘরোয়া আলোচনায় বলছিলেন তাই রেফারেন্স দিতে পারবো না, তাই নামটি উহ্য রইল। এমন ব্যাখ্যা একা তিনি দেন না। সুযোগ পেলেই দেশের ইসলামিজম, জনগণের মৌলবাদী মনোভাবকে আড়াল করতে এসব বলা হয়। অথচ লালন সাঁই মারা গেছে অনুমান করে ধরেও দেড়শো বছর। তিনি যুবক বয়সে ছেউড়িয়ায় আশ্রম করে থেকেছিলেন কাদের যন্ত্রণায়? ছেঁউড়িয়া তখন একটা জঙ্গল। বাঘ পর্যন্ত দেখা যায়। আর বিষাক্ত সাপের আখড়া। এমন জঙ্গলে লোকালয় ছেড়ে আখড়া বানালেন সাধারণ মুসলমানদের ভয়ে। বেশরীয়তী কারবার, মেয়েদের নিয়ে থাকে বিয়ে করে না, গানের মধ্যে খোদা রসূলকে নিয়ে এমন কথা বলে যা কুরআন হাদিসে নেই। হিন্দুদের সঙ্গে খোদাকে মেলায়, এইসব অভিযোগে তার শিষ্যদের মারধোর পর্যন্ত করা হয়। তখনো আমেরিকা বিশ্ব মোড়ল হয়নি। ব্রিটিশদের সহায়তায় পেশাদার ডাকাত আল সৌদ বংশ রাজতন্ত্র কায়েম করেছে। মুসলমান অভিমানী হওয়ার মত কিছু ঘটেনি। লালন যখন মুসলমানদের দৌড়ানি খেয়ে ছেঁউড়িয়া জঙ্গলে পালায়ছিল তখনো হাজি শরীয়তুল্লাহ হজ করতে মক্কা শরীফ যায়নি। শরীতুল্লাহ ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে মক্কা যান। লালনের তখন আনুমানিক ২৪ বছর। লালন তখন সমাজচ্যুত মূলত শরীয়তী সমাজের কারণে। ব্রাহ্মণদের কোপাণলেও লালন পড়েছিল। সেকথা এখানে দরকার নেই কারণ ব্রাহ্মণদের অসভ্যতার পিছনে কোন ইঙ্গ-মার্কিন হস্তক্ষেপের অভিমান তত্ত্ব কেউ দেয়নি।

তাহলে দেখা যাচ্ছে আমাদের তখাকথিত গ্রামবাংলার সহজীয়া ইসলাম কতবড় ধাপ্পাবাজী ছিল? শাহ আবদুল করিম সত্তর-আশি বছর আগে নিজ গ্রাম থেকে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে শর্ত পেলেন গান না ছাড়লে তাকে নামাজ পড়তে দেয়া হবে না। সুনামগঞ্জে কি আমেরিকা ঘাঁটি গড়েছিল? সেই অভিমানে মুসলমানরা শাহ করিমকে গান গাইতে বাঁধা দিয়েছিল? পাশে হিন্দু প্রধান গ্রামে শাহ করিম আশ্রয় নিলেন সেটা কি র’ এর হন্তক্ষেপ ছিল?

কুষ্টিয়া যেমন বাউলদের তীর্থ কুষ্টিয়া তেমনি উগ্র মুসলমানদের বাস। দুই তিনশো বছরের গ্রাম বাংলাকে বিচার করে দেখলে পাওয়া যায় পূর্ববঙ্গের মুসলমান প্রধান গ্রামগুলিতে হিন্দুয়ানী প্রভাব যতদিন ছিল ততদিন শরীয়তী ইসলাম মাথাচাড়া দেয়নি। এগুলো অঞ্চল ভেদে তফাত ছিল। বৃহত্তর ফরিদপুরে ওহাবী আন্দোলনের আগে মুসলমান নারীরা মাথায় সিঁদুর পরত, পুরুষরা ধুতি। ধুতি পরে মসজিদের মোল্লা নামাজ পড়াতো। এটা কবি জসিমউদ্দিনের লেখা। শরীয়তুল্লাহ হজ করে ফেরার পর সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের হিন্দুদের বিপরীত করতে বলা হয়। এই সামাজিক আন্দোলন পরে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়।

তাই, চট করে ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ কথাটা মাত্র একটা এঙ্গেল থেকেই হতে পারে। যুবক বয়সে নিজ গ্রামে গানের কারণে উচ্ছেদ হবার পরও বয়সকালে শাহ করিম ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ বলেছেন সেটা পরিপূর্ণ চিত্র নয়। এটা নষ্টালজিক মনের প্রকাশ। গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান গাইলেও সে গ্রামেই শাহ করিমের গানের কারণে ঠাঁই মিলে না এটাও বাস্তব। তাই একপাক্ষিক মতামত দেয়ার ফলে সত্যিকারের ইতিহাস উঠে আসবে না।



Leave a comment

About Me

সুষুপ্ত পাঠক aka Susupto Pathok is a blogger. He wrote anti-fundamentalist, anti-nationalist, anti-religious writings. Writes in favor of humanism, gender equality, non-communal society.

Newsletter

https://www.facebook.com/profile.php?id=100089104248214