প্রসঙ্গ: ৭১-এ ‘হিন্দু হলোকস্ট’

সংগীত শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের বড় বোন মধুমতি একাত্তরে দশ বছর বয়সে পাকিস্তানী সৈন্যদের বুড়িগঙ্গা নদী থেকে গানবোট থেকে গুলিবর্ষন শুরু হলে মধুমতি মা-বাবার হাত থেকে পলায়ণরত অবস্থায় চিরতরে হারিয়ে যান…। বাপ্পার বাবা এই উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীতঙ্গ বারীণ মজুমদার যিনি পাকিস্তান আমলে সংগীতের জন্য ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ পেয়েছিলেন সেই তাকেই কন্যা হারানোর বিজ্ঞপ্তিতে কেন নিজেকে মুসলিম ও কন্যাকে মুসলিম সাজাতে হয়েছিলো? বলা হয়েছিলো ফরিদা নামের একটি দশ বছরের বাচ্চা হারানো গেছে তার পিতার নাম মঞ্জুর হোসেন, তাকে পেলে সংবাদ পাঠাবার ঠিকানা :শ্রী বারীণ মজুমদার, অধ্যক্ষ, সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়, ২৮, সেগুনবাগিচা, ঢাকা-২।

যুদ্ধের ঐ সময় কি এমন ঘটেছিলো যে একজন হিন্দু নামের মানুষ তার হারানো কন্যার সন্ধান চেয়ে মুসলিম ছদ্মনামে বিজ্ঞপ্তি দিতে বাধ্য হয়? তার মানে কি কোন এক মঞ্জুর হোসেন ও তার কন্যা ফরিদা তখন ঢাকায় যতটা নিরাপদ ততখানিই বারীণ মজুমদার ও তার কন্যা মধুমতি বিপদগ্রস্ত? এই আলাদা পরিস্থিতির ব্যাখ্যা কি? মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, লেখক ও গবেষক মফিদুল হক একাত্তরে শরণার্থীদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘একাত্তরের শরণার্থীদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। পাকিস্তানি জান্তা হিন্দুদের হত্যা করে এবং ভয় দেখিয়ে দেশচ্যুত করতে চেয়েছিল। ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশে জনসংখ্যার ২০ শতাংশেরও বেশি ছিল হিন্দু। এই হিন্দুদের তাড়িয়ে দিতে পারলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জনসংখ্যার অনুপাত সমান হয়ে যেত। এটা ছিল পাকিস্তানিদের একটা হীন কৌশল।’

মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী শিবির ঘুরে গিয়ে দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’তে লেখেন, শরণার্থীদের অধিকাংশই ছিলো হিন্দু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আশফাক হোসেন বলেন, ‘শরণার্থীদের বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে; বাকিরা ত্রিপুরা ও আসামে। অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে পড়ে যে, ১৯৭১ সালে শরণার্থীদের সংখ্যা ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার সমান হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জনে এসে দাঁড়ায়। শরণার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল হিন্দু। আগস্ট ১৯৭১ পর্যন্ত হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৬৯ লাখ ৭১ হাজার এবং মুসলিম ও অন্য ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় লাখ।’

এই পরিসংখ্যা যে কেউ ইন্টারনেট থেকেও জেনে নিতে পারবেন। ৭১ সালে জনসংখ্যা ৭ কোটি হলে তখনো ২০ শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তানে ছিলো বলে জানা যায়। এখন প্রশ্ন হলো বাকী ৮০ শতাংশরা শরণার্থী না হয়ে দেশে থেকে গেলো কিন্তু ২০ শতাংশের হিন্দুরা প্রায় সবাই দেশছেড়ে পালাতে হলো কেন? উত্তরটা বিদেশী সাংবাদিক অ্যান্টনি মাসকারেনহাস তার ‘রেইপ অব বাংলাদেশে তুলে ধরেছেন। তিনি কুমিল্লায় ১৪ নং ডিভিশনের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন পাকিস্তানীরা গণহত্যার জন্য কয়েকটি ক্যাটাগরিতে জনসাধারণ বেছে নিয়েছে। যথাক্রমে-

১। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর লোক, পুলিশ এবং আধা সামারিক আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর লোক।

২। হিন্দু সম্প্রদায়

৩। আওয়ামী লীগের লোক- নিম্নতম পদ থেকে নেতৃত্বস্থানীয় পদ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের লোক, বিশেষ করে এই দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও স্বেচ্ছসেবকগণ।

৪। ছাত্র- কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত তরুণের দল ও কিছু সংখ্যক ছাত্রী। যাঁরা ছিলেন অধিকতর সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন।

৫। অধ্যাপক ও শিক্ষকদের মতো বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যারা ‘সংগ্রামী’ বলে সেনাবাহিনী কর্তৃক সব সময় নিন্দিত হতেন।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হত্যার জন্য বেছে নেয়া এই ক্যাটাগরিতে কিন্তু স্পষ্ট একটা জিনিস- তারা ঢালাওভাবে পাখির মত ‘বাঙালী নিধন’ করেনি। তারা বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে যাদেরকে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের পক্ষে নয়, পাশ্চত্য বিভিন্ন দর্শনে বিকশিত, ষাটের দশকের বাঙালী সংস্কৃতি জাগরণ, রবীন্দ্র জয়ন্ত্রী, ছায়ানট, চারুকলা ইত্যাদিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জড়িত হওয়া, মৃদু বামঘেষা শিক্ষিত বাঙালীদের সম্পর্কে তখন পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ নি:সন্দিহান যে এরাই আধা হিন্দু আধুনিক বাঙালী যারা হিন্দুদের সঙ্গে মিলে মুসলমানদের মিল্লাত ও ঐক্য ভেঙ্গে দেয়ার ষড়যন্ত্রে জড়িত। অপরদিকে পুলিশ ও বাঙালী সৈনিকরা যেহেতু অস্ত্র চালাতে পারে তাই তারা বিপদজনক। আর সংগত কারণেই আওয়ামী লীগের কর্মীদের টার্গেট করা হয়েছিলো কারণ তাদের পার্টির হাত ধরেই স্বাধীনতা সংগ্রামটা চলছিলো। কিন্তু স্রেফ ‘হিন্দু’ পরিচয়ে গণহত্যা ধর্ষণের শিকার হওয়াকে কি বলা যাবে? হিটলার তো খালি ইহুদীদের হত্যা করেনি। কিন্তু ইহুদীদের বিশেষভাবে চিহ্নত করেই তাদের গণহত্যা করেছিলো। একইভাবে ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জনযুদ্ধ হলেও পাকিস্তান জান্তা বিশেষ পরিকল্পনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায় যাকে ‘হিন্দু হলোকস্ট’ বললে আপনাদের আঁতে ঘা লাগবে কেন? কেন ইতিহাসে এই হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়াকে আলাদাভাবে স্বীকৃতি দিতে আপনাদের এত অনিহা। হ্যাঁ. হিন্দুরা ছাড়া কি মুসলিম বা অন্যান্য জাতি গোষ্ঠি ও সম্প্রদায় পাকিস্তানী জান্তাদের হাতে হত্যা নির্যাতনের শিকার হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ৯৯ ভাগই তো মুসলিম ছিলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনে সম্প্রদায়গত বিবেচনা করলে সেখানে তো মুসলিমরাই পাকিস্তান ভাঙ্গার ডাক দিয়েছিলো। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশনে নেমে হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে বিশেষ জেনোসাইডের মিশনে নেমেছিলো তার স্বীকৃতিতে অসুবিধা কোথায়? অ্যান্টনি মাসকারেনহাস স্পষ্টভাবে লিখেছেন, ‘হিন্দুদের খুঁজে খুঁজে বের করা হচ্ছিল। কারণ শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে মনে করত ‘ভারতের অনুচর’ তারা পূর্ব বাংলার মুসলমানদের কলুষিত করে ফেলেছে’। হিটলার ঠিক জার্মানিতে ইহুদীদের এই চোখে দেখত। তারপর বিশেষভাবে ইহুদীদের উপর বর্বরতা চালায়। জার্মানিরা ‘ইহুদী হলোকস্ট’ বললেও এখন বাঙালী মুসলমান ‘হিন্দু হলোকস্ট’ শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে!

আবারো বলছি, গণহত্যার শিকার কেবল হিন্দুরাই হয়েছিলো তেমন নয়। তবে আমাদের প্রচলিত ইতিহাস কখনোই হিন্দুদের উপর বিশেষ জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দেয়নি তাকে ‘বাঙালী নিধনযজ্ঞ’ বাউন্ডারীতে আটকে রেখেছে। আজ নতুন করে ভাবার বিষয় আছে কেন বারীণ মজুমদার তার হারানো কন্যা মধুমতিকে খুঁজতে মুসলিম পরিচয় গ্রহণ করেছিলেন? শুধুই পাকিস্তানীদের ভয়ে নাকি স্বদেশী মুসলিমদের প্রতি আস্থা রাখতে না পেরে? ৬৪ সালে হিন্দু নিধনের সময় পূর্ববঙ্গে মুসলিম প্রতিবেশীরা (যাদের উত্তরপুরুষরা আজকে নিজেদের কয়েক শতাব্দীর অসাম্প্রদায়িক দাবী করছেন) থাকতে কেন হিন্দু শূন্য হয়ে গেলো? তাজউদ্দিন আহমদ কন্যা শারমিন আহমদ তার বাইতে লিখেছেন, ৬৪ সালের দাঙ্গার পর স্কুলে গিয়ে দেখা গেলো শ্রেণীকক্ষগুলোতে সাত-আটজন মুসলিম ছাত্রছাত্রী ছাড়া বাকী বেঞ্চগুলো খালি। স্যারদের মধ্যে মাত্র দুইতিনজন মুসলিম শিক্ষক ছাড়া বাকী হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ মাস্টাররা উধাও। তখনো মুসলিমদের শিক্ষার হার এমনই ছিলো। তো, ৬৪ সালে সরকারী হিন্দু নিধনের সময়ে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল মুসলিম প্রতিবেশী থাকার পরও দেড় হাজার মাইল দূরের পাঞ্জাবীদের ভয়েই খালি হিন্দুরা জান হাতে নিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিলো? তাদের বাড়িঘরগুলো শত্রু সম্পত্তি করে কারা ভোগ দখল করেছিলো?

তথ্যসূত্র: শরণার্থী ৭১ অধিকাংশই ছিলো হিন্দু, রাজিব নূর, প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০১৮/ মুজিবনগরস্থ বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী বিষয়ক ভূমিকা, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, ভোরের কাগজ, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪/ নেতা ও পিতা, শারমিন আহমদ/দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ, অ্যান্টনি মাসকারেনহাস)।



Leave a comment

About Me

সুষুপ্ত পাঠক aka Susupto Pathok is a blogger. He wrote anti-fundamentalist, anti-nationalist, anti-religious writings. Writes in favor of humanism, gender equality, non-communal society.

Newsletter

https://www.facebook.com/profile.php?id=100089104248214