সামাজিক অবক্ষয় ও‘স্কুল এন্ড মাদ্রাসা’

স্কুলের নামের শেষে ‘ইংলিশ মিডিয়াম এন্ড মাদ্রাসা’ এরকম ল্যাজওয়ালা ব্যানার পুরো বাংলাদেশে ভরে গেছে। কওমি মাদ্রাসায় পড়ে তার বাচ্চারা ঢিলা কুলুপ রোদে শুকাবে এমনটা চায় না নব্য ধনী শ্রেণী। তারা চায় ছেলে ডাক্তার হবে কিন্তু জাকির নায়েকের মত বড় ভাইয়ের কোট আর ছোট ভাইয়ের প্যান্ট পরে ইসলামী স্কলারও হবে! 

মৌলবীদের মত জোব্বা নয়, জাকির নায়েকের মত শার্ট-প্যান্টের সঙ্গে মাথায় টুপি থাকবে। টাকনুর উপর প্যান্ট পরে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে। এই শ্রেণীর মনজগতকে বেস করে শিক্ষা দোকানদাররা এই নতুন ‘স্কুল এন্ড মাদ্রাসা’ হাঁসজারু সৃষ্টি করেছে।

নরমাল বাংলা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলেও বাড়তি আরবী-ইসলাম শিক্ষা চাপানো হয়েছে। মুহাম্মদের জীবনী তো সরকারী শিক্ষাবোর্ডের বইতে সব ধর্মের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়ই, আবু বকর, ওমরের জীবনী বেসরকারীভাবে এইসব ‘স্কুল এন্ড মাদ্রাসায়’ পড়ানো হচ্ছে। ইংরেজিতে ইসলামের বিধিবিধান, ইসলামী যোদ্ধা দাঙ্গাবাজদের জীবনী পড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা ৫৩ বছরে এসেও একটি একমুখী শিক্ষা করা গেলো না। এখন তো শাখা থেকে উপশাখাও বিস্তার করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। সেখানে সিলেবাসে কি পড়াবে সেটি তারা ঠিক করবে। ইংলিশ মিডিয়াম- কিন্ডারগার্ডেনের উপর সেই নিয়ন্ত্রণ। খোদ সরকারী শিক্ষাও তো ধর্মনিরপেক্ষ নয়। ফলে পরিবারের অশিক্ষা কুশিক্ষা, সাম্প্রদায়িক ট্রেনিং নিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়ে আরো বেশি করে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ হয়ে উঠছে।

আমাদের সময় প্রাইমেরি থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েরাই বুয়েট মেডিকেলে যেতো। তখন তো লেখাপড়ায় এত সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। তাহলে বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার আর মেডিকেলের ডাক্তাররা এত হুজুর হলো কি করে?

মধ্যপ্রাচ্য কানেকশন আমাদের সর্বনাশ করেছে! আশির দশকে সৌদি কাতার বাহরাইন দুবাই শ্রমিক শ্রেণী যেমন কাজ করতে গেছে তেমনি সাদ্দাম হোসেনের ইরাকেও মধ্যবিত্ত শ্রেণী চাকরি নিয়ে গেছে। বহু ইঞ্জনিয়ার ডাক্তার ইরাক ইরান গেছে। এসব দেশে যাবার ফলে মুসলিম ব্রাদারহুড রিলেশন শক্তিশালী হয়। রেজা শাহের ইরানে সরকারীভাবে ইরানী নারীদের ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকা ভ্রমণ করানো হতো। যাতে ইরানের ইসলামী ভাবধারার বাইরে ভিন্ন সভ্যতা কালচারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ইরানী নারীদের সাংস্কৃতিক স্বাস্থ উন্নত হয়ে উঠে। আশির দশকের পর সৌদিতে কাজ করা শ্রমিকরা বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে কুঁড়ের ঘরের বদলে পাকা বাড়ি তৈরি করলো। স্বচ্ছল গ্রামীণ জীবনের সূচনা করলো। একই সঙ্গে সৌদি থেকে বোরখার কাপড় আসতে লাগলো। সৌদিতে থাকা কর্তা ততদিনে আসল ইসলামের সন্ধান পেয়ে গেছেন। ফলে পরিবারকে সত্যিকারের ইসলাম মত চলতে নির্দেশনা আসতে লাগল। গ্রামীণ বিয়ের লোকজ সংস্কৃতিতে থাবা পড়ল ওহাবিজমের। প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় মসজিদ মাদ্রাসা তৈরি হচ্ছিল। এর পাশাপাশি সৌদি আরব তেল বেচা টাকায় ভারতীয় উপমহাদেশে দেদারছে মাদ্রাসা হতে লাগল। সৌদি আমেরিকা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমেরিকার পরামর্শে সৌদি তার তেলের টাকায় জিহাদী তৈরিতে মাদ্রাসার জন্য ডলার পাঠাতে লাগল বাংলাদেশ পাকিস্তানে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নানা ছক কষে মাদ্রাসার বাড়বাড়ন্ত হলো। সৌদি আরব নিজের বানানো মাদ্রাসা ফ্রাঙ্কাস্টাইনের কবলে পড়ে যখন রাজতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ল তখনই হুঁশ হলো। ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের মুসলমানদের সৌদিরা দু নম্বরী মুসলমান মনে করত। সেই দু নম্বরী মুসলমানরাই এখন সৌদিদের চেয়েও সহি মুসলমান হতে দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছে।

ভারতের বিষয়টা একটু জটিল। দেশ স্বাধীন হবার পর দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে সেই প্রশ্নে ফের হিন্দু মুসলমান প্রসঙ্গ চলে আসল। মুসলমানদের জন্য যেহেতু পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে তাহলে ভারত কেন আবার শিক্ষা ব্যবস্থা হিন্দু মুসলমান কেমন হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে গেলো? নেহরু কেন সেটা মানতে গেলো? সিদ্ধান্ত হলে হিন্দু মুসলমান নিজেরা ঠিক করবে নিজেদের শিক্ষা কেমন হবে। নেহরু টোল উঠিয়ে দিয়ে শিক্ষাকে করলেন আধুনিক পাশ্চাত্যমুখী। মুসলমানরা নিজেদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম বেছে নিল! এর ফলেই ভারতের মধ্যে দেওবন্ধের মত একটা খিলাফতবাদী জিহাদী টেক্স একাডেমি বেঁচেবর্তে থাকল! মুসলমানরা মাদ্রাসা ও ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাক্রম দুটোই ব্যবহার করতে পারল। ফলে জাকির নায়েকের মত একটা কোলাজের জন্ম খুব অস্বাভাবিক হলো না। এরকম কোলাজ ভারতীয় ধনী শিক্ষিত পরিবারে অভাব নেই। তারা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সঙ্গে হুজুর! এই শ্রেণীর ‘মডার্ণ হুজুর’ তৈরি করতে জাকির নায়েক খুলল পিস স্কুল। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা যদি স্বাধীনতার পর মুসলমানদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা চালু না করত তাহলে জাকিরের পিস স্কুল নামে বেনামে কি চালু হতে পারত?

এই শতকে এসে বাংলাদেশের সমাজে বড় রকমের একটি পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিছু মানুষের হাতে অঢেল টাকা এসে গেছে। ফলে ওমরা হজ করার পরিমাণ বেড়ে গেছে ব্যাঙের ছাতার মত। অঢেল টাকা আসাটা সব সময়ই লিগ্যাল পথে আসে না। ঘুষ ও সিন্ডিকেট ব্যবসা বাংলাদেশে এক শ্রেণী ধনীর জন্ম দিচ্ছে প্রতিবছর। এরাই ওমরা করে। এরাই নিজেদের বাচ্চাদের জন্য ‘স্কুল এন্ড মাদ্রাসা’ খোঁজে। অবৈধ অর্থ ও ইসলামিক শিক্ষাক্রম হাত ধরে চলে। যেখানে দুর্নীতি অসততা সেখানেই মন্দির মসজিদ বেশি বেশি করে গড়ে উঠে। পৃথিবীর ইতিহাস সেটাই বলে। তাই ‘স্কুল এন্ড মাদ্রাসা’ আমাদের অবক্ষয়ের একটি প্রতীক মাত্র।



Leave a comment

About Me

সুষুপ্ত পাঠক aka Susupto Pathok is a blogger. He wrote anti-fundamentalist, anti-nationalist, anti-religious writings. Writes in favor of humanism, gender equality, non-communal society.

Newsletter

https://www.facebook.com/profile.php?id=100089104248214