কেন বই পড়ি?

আমার পড়াশোনা শুরু দেশ পত্রিকার ‘অরণ্যদেব’ দিয়ে। এটাই পড়তাম। তখন হাফপ্যান্ট পরি। নেহাতই বালক। এমন জায়গায় থাকি সেখানে দেশ পত্রিকা বাসায় রাখা একেবারেই বেখাপ্পা। এসবের কারণেই আমিও বেখাপ্পা হয়ে গিয়েছিলাম পরবর্তীকালে। আর সব ছেলেদের মত না হয়ে বখে গেলাম আর কী! টিফিনের টাকা দিয়ে আনন্দমেলা, সন্দেশ, ফেলুদা কিনে পড়তাম। এসব কিনে পড়ে জীবনের এইমটাই যেন ফসকে গেলো!

আসলেই কি বই আমাকে অন্য রকম করে দিয়েছিল সবার থেকে?

আরে না! আমাদের স্কুলের সেকেন্ড বয় মেধাবী ছেলেটা ছিল বইয়ের পোকা। যখন কলেজে পড়ছি তখনো দেখি সে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যায়। একটা পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে তখনই সে বেশ ভালো রকমের জড়িত। প্রচুর পড়ত। এসব পড়তে গিয়ে তার ব্যাংকার হতে সমস্যা হয়নি। নামাজী মডারেট মুসলমান হতে সমস্যা হয়নি। সে এখনো পড়ে। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি বেশিরভাগ মানুষকেই বই প্রভাবিত করতে পারে না। এরা সুখী। কারণ এরা নির্বোধ। এটাও জেনে রাখবেন নির্বোধরাও বই পড়ে!

বোমক্যাশের একটা ডায়লগ আছে, বুঝলে অজিত, সব কিছু রক্তে থাকতে হয়। পিস্তল দিয়ে গুলি চালিয়ে খুন করা তোমাকে আমাকে দিয়ে হবে না…। এই রকমই কথাগুলো। খুব মনে দাগকাটা কথা। সব কিছু রক্তে থাকতে হয়। আমি সমাজের বাইরে দিয়ে চলব এটা আমার রক্তে ছিল। বাকীটা বই উশকে দিয়েছে আর কী। বইয়ের ভূমিকাকে অস্বীকার করছি না পুরোপুরি।

বই কত খুনির জন্ম দেয়। একটা বই পৃথিবীতে ১৫০টির উপর ভয়ংকর জঙ্গি দলের জন্ম দিয়েছে যারা ঠান্ডা মাথায় অবিশ্বাসীদের গলা কাটে! বইয়ের ভূমিকা তাই অস্বীকার করার উপায় কই?

আমাদের বাড়িতে খুব যে বই ছিল তা নয়। ঈদ সংখ্যা বিচিত্রা, শরত রচনা সমগ্র, প্রগতী প্রকাশনীর রুশ বাংলা অনুবাদে নিকোলাই তিখনভের একটা বই। একটা কুরআন শরীফ। কয়েকটা নূরানী কায়দা। কুরআন শরীফ পড়া হতো রোজার সময় সোয়াবের আশায়। না বুঝে আরবী পড়তে শেখার এক অদ্ভূত কৌশল! আমিও অল্প বয়সে কুরআন পড়েছি গড় গড় করে…।

কারোর বাড়ি গিয়ে তখন বই দেখেছি এমনটা মনে পড়ে না। তখন সোশাল মিডিয়া ছিল না। লোকজন কি খুব পড়ত নাকি তখন? তাহলে এখন সোশাল মিডিয়ার দোষ দেয়া হয় কেন? ঈদ সংখ্যা কি ঘরে ঘরে দেখা যেতো তখন? খবরের কাগজই রাখতো না! বেশির ভাগ লোক ফাও খবর কাগজ পড়ার ধান্দায় খাকত। আর বিবিসি রেডিওতে খবর শুনত। বই পড়ে এমন লোকজন চোখে দেখিনি। পাবলিক লাইব্রেরি ছিল দুটো। সেখানে লোকজন বেশিরভাগ অলস সময় কাটাত খবরের কাগজ পড়ে না হয় ম্যাগাজিন পড়ে। সিনেমা ম্যাগাজিনের চাহিদা বেশি ছিল। টেলিভিশন নাটকের কারণে হুমায়ূন আহমেদ ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার বই কেবল পড়ত স্কুল কলেজের বাচ্চারা। বই পড়া বরং এখন বেড়েছে! সিরিয়াস রকম বই পাঠের চর্চা সোশাল মিডিয়ার যুগেই শুরু হয়েছে। ইউটিউবের অডিও বুক ক্লাসিক বাংলা লেখকদের বিষয়ে পাঠকদের আগ্রহী করে তুলেছে। তার প্রমাণ বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের আবার বেস্ট সেলার হয়ে উঠা।

বই খুব ভালো জিনিস সব সময় তা নয়। মন্দ একটা বই, অথচ খুবই মনোগ্রাহী করে লেখা কোন বই একটা মানুষকে পিশাচে পরিণত করতে পারে। হিটলারের আত্মজীবনীতে তিনি ভিয়েনায় একজন কলামিস্টের কথা লিখেছেন যার কলাম তাকে প্রবলভাবে উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদী হতে উশকে দিয়েছিল। ফলে বই মানেই ভালো কিছু সব সময় নয়। বই বহু জ্ঞানপাপী মানুষ লিখে। তারা পাঠককে বিভ্রান্ত করে ফেলে। বই লেখে পার্টির লোকজন। তারা তাদের ইতিহাস অর্থনীতি তাদের পার্টি লাইনে লেখে। এসব লেখা বস্তুনিষ্ঠ হয় না। ফ্যানাটিকরা মহাপরুষদের জীবনী লেখে। এইসব জীবনী কত খুনিকে মহাপুরুষ বানিয়ে রেখেছে। ইতিহাসের বই তো লিখেছে বিজয়ীরা। সেসব বইতে সত্যের চাইতে গালগল্প ছাড়া আর কিছু নেই।

এক ভাদ্রের তপ্ত দুপুরে তেমনই একটা বিজয়ীদের লেখা বই আমার হাতে এলো। ‘রূহ’ নামের একটা ইসলামিক বই কে যে বাসায় এনেছিল জানি না। আমার তখন ঠোঁটের নিচে পাতলা গোঁফের রেখা সবে দেখা দিয়েছে। ইসলামী ফাউন্ডেশনে প্রকাশিত বইটি আমি পড়া শুরু করলাম। একটা জায়গা ছিল এমন, বদরের যুদ্ধে নবী মুহাম্মদ কুরাইশদের লাশগুলো একটা গর্তের মধ্যে ফেলে কোমড়ে দুহাত রেখে বলতে লাগল, কোথায় তোমাদের প্রভূ সে তোমাদের রক্ষা করতে এলো না…। এই লাইনটা পড়ে আমি জাস্ট ব্রজাহতের মত হয়ে গেলাম!

অনেকগুলো জাল হাদিস দিয়ে আমাদের সমাজে নবীর যে কোমল দয়ালু চরিত্র শেখানো হয়েছিল এই চিত্র ছিল তার একদম বিপরীত। বইটি যে সে লিখেনি। প্রখ্যাত ইমাম শামসুদ্দিন আবু আবদুল্লাহ ইবনুল কাইযুমের লেখা বই। আমার পারিবারিক ধর্মের খুঁটি নড়ে গেলো। একটা বই মানুষকে নড়িয়ে দিতে পারে দুইভাবে। একই বই পড়ে নিশ্চয় অন্য পাঠক নিষ্ঠুরতায় অনুপ্রাণিত হয়েছে। আমার হয়েছে উল্টো ফল। আমার কোমল মন এটা নিতে পারেনি। আমি অনুসন্ধানী হয়ে উঠলাম। ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য এরপর একের পর এক বই আমাকে পড়তে হয়েছে।

বই পড়ার কারণে মানুষজনের কাছে যে পরিমাণ হেয় শিকার হয়েছি বলার মত নয়। বেশিরভাগ মানুষ মনে করে তাদের এত সময় নেই! মানে যারা বই পড়ে তারা মূলত আজাইরা। এইসব কাজের লোকজন আবার তর্কের সময় আমাকে বলত আমি যেন মরিস বুকাইলির কুরআন এন্ড বাইবেল বইটা পড়ি তাহলে আমার কাছে সব পরিস্কার হয়ে যাবে। যারা বলত তারা কেউ এই বই পড়েনি। তারা শুনেছে এই বইতে একজন খ্রিস্টান বাইবেলের ভুল বের করে দেখিয়ে কুরআনের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রমাণ দেখিয়েছেন। এই বই পৃথিবীর সব ভাষায় অনুবাদ করে বিলিয়ন বিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। এসব বইয়ের ক্রেতা মুসলমানরা। বাংলাদেশে এই বই বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। আমি ফুটপাথ থেকে এক কপি কিনে পড়েছি। যারা আমাকে এই বই পড়তে পরামর্শ দিয়েছে তারা জানেই না এই বইতে কি লেখা আছে। ফলে তাদেরকে যখন আমি জিজ্ঞেস করেছি, বাইবেলে এত ভুল থাকার দায় কার? আল্লার নয়? বুকাইলি এত বুঝেও তাহলে মুসলমান হলেন না কেন? তারা কোন সদুত্তোর দিতে পারেনি। বুকাইলির সব বাটপারি ধরিয়ে পরবর্তীকালে বই লেখেন ইউলিয়াম ক্যাম্বেল। সেই বইয়ের অনুবাদ কোন সাহসী প্রকাশক করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত বইটি আমার কাছে আছে। এত কথা বলার কারণ হচ্ছে ভালো বই খারাপ বই যে আছে সেকথা মুগ্ধ পাঠককে মনে করিয়ে দিতে হবে।

তবু, কারোর বাড়িতে বই না থাকলে তাদেরকে আমার দরিদ্র মনে হয়। রুচিহীন আনকালচারড লাগে। অন্তত দশটি ক্লাসিক নিজ ভাষার সাহিত্য না পাঠ করা থাকলে, দশটি বিদেশী ভাষার ক্লাসিক সাহিত্য পড়া না থাকলে, ইতিহাস, দর্শনের বিষয়ে সামান্য পড়া না থাকলে- আপনার যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীও থাকে তবু আপনি অশিক্ষিত!



Leave a comment

About Me

সুষুপ্ত পাঠক aka Susupto Pathok is a blogger. He wrote anti-fundamentalist, anti-nationalist, anti-religious writings. Writes in favor of humanism, gender equality, non-communal society.

Newsletter

https://www.facebook.com/profile.php?id=100089104248214