বৈশাখের ফসিল

একটা পিস্তলের দোকানে দাঁড়িয়ে আছি। দোকানদার পিস্তলের টিগার চাপছেন ঠাস ঠাস করে। এক রাউন্ড গুলি ভরলেন। তারপর ফায়ার করলেন। বাতাসে বারুদের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। কাস্টমারকে দেখালেন কিভাবে ব্যবহার করতে হবে। পিস্তলের ক্রেতা এক বালক। বালকের বাবা দেখে শুনে রাজি হলেন কিনতে।

দোকানদার লোকটি এতগুলি বছরে একই রকম রয়ে গেছে। মনে হয় তার বয়স থেমে আছে আমার শৈশবে…। আমি বালক থেকে পিস্তল নিয়ে খেলার দিন শেষ করে কবে ‘যে জীবন দোয়েলের যে জীবন ফড়িংয়ের’ পেছনে ফেলে ‘বড়’ হয়ে গেলুম- তবু শৈশবের পিস্তলের দোকানীর বয়স বাড়ে না! লোকটি আমার দিকে একবার তাকালেন। তার কিশোর ক্রেতাকে এতবছর পর চেনার কথা নয়। কনডেন্সড মিল্কের টিনের কৌটো কেটে বানানো পিস্তল, লাল কাগজে বারুদের স্টিপ। হাতে নিয়ে দেখলাম। ঠাস ঠাস করে ফায়ার কলাম। পিস্তলের দাম বিশ টাকা, কার্তুজ দশ টাকা।

একটা পিস্তল হাতে নিয়ে মেলায় ঘুরতে লাগলাম। এখনো মেলায় লোক আসেনি। বারোটার মত বাজে। মেলা মাত্র সাজছে। দুপুরের পর মেলা জমবে। আমার মত অনেকেই মেলায় ঘুরছে। ছেলেদের হাতে বাঁশি। যে যার মত ফুঁ দিয়ে প্যাঁ-পোঁ শব্দ তুলছে। মেলার বাঁশির সুর তাল লয় কিছু থাকে না। তবু বৈশাখের তপ্ত বাতাসে মেলার বাঁশির চেয়ে মধুর আর কী আছে?

নিমকি পিটি জিলাপীর দোকানের উনুন জ্বলছে। বড় বড় কড়াইয়ে তেল ফুটছে। এখনো ভাজা শুরু হয়নি। এক নামে সবাই হরির জিলাপী চেনে। গরম গরম হরির জিলাপী যে না খেয়েছে তার জীবনটাই বৃথা! হরির এখন বয়স হয়ে গেছে। ক্যাশে বসে আছে খালি গায়ে। ছেলেরা খাটছে। হরির মুখটা কত পরিচিত। পুরো জীবনটাই কাটিয়ে দিলেন জিলাপীর প্যাঁচ কষে কষে…!

স্যাকারিন মেশানো রঙিন জল সেভেনআপ পেপসির বোতলে ভরে আজো বিক্রি হয়! লটারিতে আজো প্রথম পুরস্কার একটা লাক্স সাবান! আজো মাটির পুতুল, মাটির হাড়ি পাতিল, মাটির রবীন্দ্রনাথ, ফনা ধরা সাপ, হনুমান মুখোশ, আমার বোনের সঙ্গে এসে কত দুপুর হাড়ি পাতিল কিনে, পিস্তল, পিটি নিমকি জিলাপী নিয়ে বাড়ি ফিরেছি…।

বেদেনীদের চুরির দোকানগুলোতে ছোটবেলায় কোন আগ্রহ ছিল না। তাদের উদ্ভট সাজ, মুখের চাউনি, আই ডোন্ট কেয়ার ভাব কেমন ভয় করত। এখনো মনে আছে একটা মেয়ের চুড়ির দামাদামি পছন্দ হয়নি বলে বেদে মেয়েটি নিরাসক্তভাবে জবাব দিয়েছিল, আফা গাঞ্জা খাইয়া দাম কইয়েন না…!

মেলা থেকে চুড়ি কিনে প্রেমিকাকে পরিয়ে দেয়ার ইচ্ছে ছিল খুব। কোন একটা মেয়ে শাড়ি পরে আমার সঙ্গে মেলায় যাবে। তাকে নিজ হাতে চুড়ি পরিয়ে দিবো…। কিন্তু বছর বছর মেলা হলেও একটা প্রেমিকা না জুটাতে পেরে সময়টা দীর্ঘশ্বাসে মিলিয়ে গেছে…।

সেই বেদেনীদের চুড়ির দোকান আজো আছে। আজো কোলের পুটলিতে বাচ্চা নিয়ে তারা চুড়ি বিক্রি করছে। চরকগাছের মোচড় মোচড় শব্দ, বেসুরো বাঁশির সুর, কাঠের উনুনের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মেলা ফিরিয়ে দিচ্ছিল আমাকে কয়েকটা দশক আগের স্মৃতি…।

সেই মেলাটা আজ দশ বছর ধরে বন্ধ। সরকারিভাবে দেড়শো বছরের পুরোনো বৈশাখী মেলা বন্ধ করা হয়েছে। প্রশাসনের অনুমতি নেই।

শূন্য বটতলায় এখন লিজ নিয়ে মাদ্রাসা হবার সাইনবোর্ড ব্যঙ্গভরে চেয়ে আছে আমাদের দিকে…।



Leave a comment

About Me

সুষুপ্ত পাঠক aka Susupto Pathok is a blogger. He wrote anti-fundamentalist, anti-nationalist, anti-religious writings. Writes in favor of humanism, gender equality, non-communal society.

Newsletter

https://www.facebook.com/profile.php?id=100089104248214